ফেলে আসা কৈশোরের দিনগুলোতে...
তখন আমি মাদারীপুরে অধ্যায়নরত ছিলাম। ইংরেজি ২০১৭/১৮ খ্রিস্টাব্দ হবে।
প্রায় ছ'সাতমাস পর গ্রামে গেলাম। আমাকে পেয়ে সজীব, ফারুক, নাঈম আর মীম উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলো। খবর পেয়ে— তানজীমুল বাড়ি থেকে ছুটে এলো। নিতাই থেকে ছোট ফুপি এলো। আমাকে পেয়ে রিয়াদ ও হৃদয়ও খুব খুশি হলো।
সেদিন পড়ন্ত বিকেলে নাঈম, ফারুক ও সজীব সিদ্ধান্ত নিলো- আমাকে নিয়ে আজরাতে চড়ুইভাতি করবে।
রিয়াদ, হৃদয় আর তানজীমুল থাকায় এবারের চড়ুইভাতি ভিন্নভাবে একটু বড় পরিকল্পনায় হবে!
সজীব চাল দেবে, আমি মশলা ও তেল, নাইম রশুন আর আদা, ফারুক হলুদ, মরিচ ও লবণ নিয়ে আসবে। সাথে প্রত্যেকে ২০ টাকা করে দেবো; যা দিয়ে বাজার থেকে মাংস কিনে আনবো। জায়গা ঠিক হলো—নাঈমদের পুকুরপাড়ের খেজুর গাছের আড়ালে। সেখানে কেউ দেখতে পাবে না। যাবেও না। প্ল্যান মতো, সূর্যের আলোতেই সবাই মিলে সেখানকার আশপাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করলাম।
প্রস্তুতির ঝড়ো হাওয়া...
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।
পরিকল্পনা মতো সবাই বাড়ি থেকে লুকিয়ে-চুরিয়ে— চাল-ডাল, পিয়াজ, মরিচ, আদা-রশুন, ঘর বানানোর কাপড় ইত্যাদি নিয়ে এসে, পুকুরপাড়ে লুকিয়ে রাখলাম। কিন্তু মীম বিষন্ন মনে এসে বললো, তাকে রাত্রী বেলায় বাড়ি থেকে বের হতে দেবে না। কারো সাথে থাকতেও পারবে না। চড়ুইভাতির কথা শুনলে, তার বাবা-মা ভীষণ রাগ করবে। কী করা যায়...
ভাবতে-ভাবতে ফারুক ও সজীব তাকে আইডিয়া দিয়ে বললো, তুই তোর মা'কে বলবি— আজ রাতে আযীয আংকেলের সাথে থাকবি। কিছু বললে বলবি, আংকেল থাকতে বলেছে। ব্যাস!
মাগরীবের পর...
তালপুকুরের মেঠোপথ ধরে সবাই মিলে হাজারীহাট গেলাম মুরগী কিনতে। মুরগীর ব্যাগ নিয়ে কী-যে আনন্দে ফিরছিলাম! মনে হচ্ছিল, আমরা ৮ জন দিগ্বিদিক জয় করে ফিরতেছি! পথটা যেন দ্রুতই ফুরিয়ে গেলো।
মুরগীর ব্যাগসহ পুকুরপাড়ে চলে এলাম। সিদ্ধান্ত হলো, যার-যার মতো করে ম্যানেজ করে, রাত সাড়ে দশটায় পুলেরপাড়ে একত্রিত হবো।
চুড়ান্ত অভিযান...
রাত সাড়ে বারোটা। ফারুক, নাঈম আর সজীব গেলো লাকড়ি জোগাড় করতে। রনি আর তানজীমুল পা টিপেটিপে গেলো রান্নাঘরে, রান্নার পাতিল আনতে। মীম আর রিয়াদ গেলো পানি আনতে। আমি হৃদয়কে নিয়ে গেলাম পুকুরপাড়ে রান্নার প্রণালী তৈরি করতে...
ভূতের ভয়, অন্ধকারে ভয়ের পেছনে যে গল্প ছিল
আমি চাল-ডাল ও পিয়াজ-মরিচগুলো প্রস্তুত করছি। হৃদয় পাশে বসে আছে। এমন সময় সে বাঁশঝাড়ের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে এবং আমাকে ঝাপটে ধরে। আমি ওর মুখ চেপেধরি। ও চিৎকার দিয়ে বলে, ভাইয়া ওটা কি! ওটা কি!! আমিও ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে উঠি। ভয়ে সেদিকে তাকানোর সাহস পাই না। আশেপাশে তখন কেউ নেই। গুমোট অন্ধকার। হৃদয় ভয়ে কাঁপছে আর আমার বুকে ওর মুখটা লুকিয়ে রেখেছে। ক্রমশঃ আমার বুক কেঁপে ওঠে। বিভিন্ন জল্পনা-কল্পনা মাথায় ভেষে ওঠে। মনে-মনে নানান দোয়া-দরুদ পড়তে থাকি। হৃদয় কেঁদে ওঠে, বায়না ধরে বাসায় যাবে। আমি শক্ত করে ওর মুখ চেপে ধরি। আর বুঝানোর চেষ্টা করি। ও শক্ত করে আমাকে ঝাপটে ধরে আছে। আমার মনে হচ্ছে, সাদা কাপড় পরিহিত কেউ একজন আমার পিছনে, বিশালাকার দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা ঘোরালেই ঘার মটকে দেবে! আমার গা শিউরে ওঠে। হৃদয়কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি। আমি মাথা তোলার সাহস পাচ্ছি না।
হটাৎ হৃদয় আবারও চিৎকার করে বলে উঠলো ভাইয়া ওটা কী? ভুত ভুত! আমি ওর মুখ চেপে ধরলাম। ও কেঁদে উঠলো। আমিও তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলাম। দেখি, পুকুরের ওপাড়ে দু'টি আত্মা বড়বড় লাঠি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতেছে! আমার গা ঘেমে উঠলো! চিৎকার করতে চেয়েও পারলাম না, মনে হলো- অদৃশ্য একটি হাত আমার কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে। হৃদয় একেবারে চুপসে গেছে। আমি আত্মা দু'টোর দিকে তাকাচ্ছি আর কাঁপতেছি। হৃদয় সেদিকে তাকাতেই চিৎকার করে উঠলো! ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে কাঁপতে লাগলো। ওর সাথে আমিও চিৎকার দিয়ে উঠলাম। সাথে সাথেই আত্মা দু'টো দৌড়ে আমাদের কাছে আসলো। এসেই নাঈম বললো, কী হয়েছে ভাইয়া? আমি চমকে গেলাম! বললাম, তোরা! তোরা এখানে ছিলি? ফারুক ফিসফিস করে বললো, ঐদিকে লাকড়ি পেলাম না। তাই এখানে এসেছি। সাথে-সাথে মীম, রিয়াদ, রনি ও সজীবও আসলো। আমি ওদের সবাইকে বিষয়টি খুলে বললাম। ওরা খিলখিল করে হেসে উঠলো। কিন্তু হৃদয় কিছুই বুঝতে পারলো না, কেবল ভয়ে কাঁপতে লাগলো। আর বাসায় যাওয়ার বায়না ধরলো। নাঈম, ফারুক আর সজীব কাপড় দিয়ে চতুর্দিকটা ঘিরে দিলো; যাতে হৃদয় বাহিরের কোনকিছু দেখতে না পায়। মীম, রিয়াদ ও রনি হৃদয়কে তাদের মাঝখানে বসিয়ে নিলো।
রান্নাবান্নায়...
কাপড়ের ঘেরা ছোট্ট ঘরের ভেতর আমরা রান্নাবান্না শুরু করলাম। নাঈম চুলোয় জ্বাল দিচ্ছে। আমি আর ফারুক রান্না করছি। চুলোর সামনে সবাই ছোট্ট হৃদয়কে নিয়ে ফিসফিসিয়ে মজা করছে।
ভাত রান্না করার পর কীভাবে মার গলাতে হবে কেউ বুঝতে পারছিলাম না। ফারুক ঝটপট একটি আইডিয়া বের করলো। দু'টো কলাপাতা লম্বালম্বি দিয়ে ভাতগুলো সেখানে ঢেলে দিলো। চতুর্দিক দিয়ে মারগুলো বেয়ে গেলো; কিন্তু ভাতগুলো ভেজায় থাকলো।
মাংস রান্না শেষে কলাপাতায় সকলে ভাত তুলে নিলাম। ভেজাভাতে লবন ও ঝালে চড়া মাংসের স্বাদ আজও আমার জিভে লেগে আছে। পুকুরপাড়ে দাঁড়ালে মনের অজান্তেই হেঁসে উঠি। ছুটে যাই ফেলে আসা সেই কৈশোরের দুরন্তপনায়...
▪️ঢাকা